প্রশ্ন(105\1) : কুরআনে বলা আছে, যারা জাহান্নামে যাবে তারা চিরস্থায়ী জাহান্নামী। কিন্তু ছহীহ বুখারীতে রয়েছে যে, আল্লাহ এক সময় মুসলিম জাহান্নামীদেরকে মাফ করে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। তাহলে কি এই হাদীছটি কুরআনের ঐ আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক নয় কি?
উত্তর : কুরআনের আয়াত ও হাদীছ পারস্পরিক সাংঘর্ষিক নয়, বরং দু’টিই স্ব-স্ব স্থানে প্রাসঙ্গিক এবং একে অপরের পরিপূরক। সাধারণত আল্লাহ যত জায়গায় خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَا ‘তারা জাহান্নামে স্থায়ী হবে’ বলেছেন, তার প্রায় জায়গাতেই কাফির, মুশরিক অথবা মুনাফিকদেরকে সম্বোধন করে বলেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا وَ کَذَّبُوۡا بِاٰیٰتِنَاۤ اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ النَّارِ خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَا ؕ وَ بِئۡسَ الۡمَصِیۡرُ
‘আর যারা কুফরী করবে এবং আমার নিদর্শনসমূহকে অস্বীকার করবে, তারাই জাহান্নামের অধিবাসী; সেখানে তারা স্থায়ী হবে। কত মন্দ ঐ প্রত্যাবর্তনস্থল!’ (সূরা আত-তাগাবূন : ১০)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় আহলে কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে যারা কুফরী করেছে, তারা জাহান্নামের আগুনের মধ্যে স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে; তারাই সৃষ্টির অধম’ (সূরা আল-বাইয়্যিনাহ : ৬)। তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহ মুনাফিক পুরুষ, মুনাফিক নারী ও কাফিরদেরকে জাহান্নামের আগুনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে, এটা তাদের জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তাদেরকে অভিশাপ করেছেন। আর তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী শাস্তি’ (সূরা আত-তওবাহ : ৬৮)। এছাড়াও সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৬১-১৬২, ১৬৭; সূরা আলে ‘ইমরান : ৮৮; সূরা আন-নিসা : ১৬৯; সূরা আল-মায়িদাহ : ৩৭; সূরা আল-নাহল : ২৮-২৯; সূরা আয-যুমার : ৭২; সূরা আল-গাফির : ৭৬; সূরা আল-হাশর : ১৭ এবং সূরা আল-জিন : ২৩ আয়াতসমূহে বর্ণিত হয়েছে।
হাদীছের মধ্যে যাদের ক্ষমা করার কথা বলা হয়েছে তারা হল- পাপী মুসলিম। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ إِلَّا نَفْسٌ مُسْلِمَةٌ ‘মুসলিম ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না’ (ছহীহ বুখারী, হা/৩০৬২, ৪২০৩-৪২০৪, ৬৬০৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১১১, ২০৫)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘…এবং আমার উম্মতের অবশিষ্ট লোকদের জাহান্নামীদের সঙ্গে জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে। অতঃপর জাহান্নামবাসীরা বলবে, ‘তোমরা যে আল্লাহর ইবাদত করতে এবং তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক করতে না, আজ তা তোমাদের কোন উপকার করতে পারল না।
একথা শুনে আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, ‘আমার সম্মানের কসম, আমি অবশ্যই তাদের জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেবো। সুতরাং তাদের জাহান্নাম থেকে এমতাবস্থায় বের করা হবে যে, তারা জ্বলে-পুড়ে জড়োসড়ো হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর তাদের আবে-হায়াত (জীবন) নামক নদীতে প্রবেশ করানো হবে, ফলত স্রোতবাহিত উর্বর পলিতে গজিয়ে উঠা শস্য দানার ন্যায় তারা সজীব হয়ে উঠবে। তাদের ললাটে লিখে দেয়া হবে, ‘এরা আল্লাহর পক্ষ থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত দল। অতঃপর তাদের নিয়ে গিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। জান্নাতবাসীগণ তাদের জাহান্নামবাসী বলে সম্মোধন করলে, আল্লাহ বলবেন, ‘বরং এরা আল্লাহর পক্ষ থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত দল’ (মুসনাদে আহমাদ, হা/১২৪৬৯-১২৪৭০; ইবনু খুযাইমা, হা/৬০১; দারেমী, হা/৩৫; ইবনু মানদাহ, হা/৮৭৭, সনদ হাসান)।
অন্যত্র নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘…কতকগুলো সম্প্রদায় তাদের গুনাহের কারণে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে এবং জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। অতঃপর আল্লাহ নিজ রহমতে তাদেরকে ক্ষমা করে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। তাদেরকে ‘জাহান্নামী’ বলা হবে’ (ছহীহ বুখারী, হা/৬৫৫৯, ৬৫৬৬, ৭৪৫০)।
*********************************************************************
প্রশ্ন(105\2) : সূরা হূদের ১০৭ ও ১০৮ নং আয়াতে জান্নাতবাসী ও জাহান্নামীদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, তারা অনন্তকাল সেখানে থাকবে, যে পর্যন্ত আসমান ও যমীন স্থায়ী থাকবে। তবে আল্লাহ অন্য কিছু চাইলে ভিন্ন কথা’। উক্ত আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, এক সময় জাহান্নামের শাস্তি থেকে সবাইকে রেহাই দেয়া হবে। চিরস্থায়ীভাবে কাউকে জাহান্নামে থাকতে হবে না। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা জানিয়ে বাধিত করবেন।
উত্তর : উক্ত আয়াত থেকে অনেকে বুঝেছেন যে, জাহান্নামে কাফেরদের শাস্তি স্থায়ী হবে না। একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শাস্তি হবে। অর্থাৎ যতদিন আসমান ও যমীন বিদ্যমান থাকবে ততদিন তাদের শাস্তি হবে। উক্ত ধারণা সঠিক নয়। কারণ আরবদের রীতি ছিল, কোন জিনিসের স্থায়িত্ব বুঝানোর জন্য তারা বলত هذا دائم دوام السماوات والارض ‘আসমান ও যমীনের ন্যায় এটা চিরস্থায়ী’। আরবদের এই ভাষারীতিই কুরআন মাজীদে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ কাফের-মুশরিকরা চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামে থাকবে। এ বিষয়ে কুরআনের বহু আয়াতে বর্ণিত রয়েছে। যেমন বাক্বারাহ ১৬১-৬২, আলে ইমরান ৮৮; তওবা ৬৮; আহযাব ৬৪-৬৫; যুমার ৭২ প্রভৃতি।
এছাড়া অনেক ছহীহ হাদীছে জাহান্নামীদের চিরস্থায়ী শাস্তির কথা বলা হয়েছে। যেমন- ‘মৃত্যুকে সাদা-কালো মিশ্রিত রংয়ের একটি দুম্বার আকৃতিতে হাযির করে জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝে যবেহ করা হবে। অতঃপর বলা হবে, হে জান্নাতবাসীগণ! মৃত্যুহীন স্থায়ী জীবন যাপন করো। হে জাহান্নামীরা! মৃত্যুহীন স্থায়ী জীবন যাপন করো (বুখারী হা/৪৭৩০ ‘তাফসীর’ অধ্যায়; মুসলিম হা/২৮৪৯)। দ্বিতীয়তঃ আসমান ও যমীন থেকে জিনস উদ্দেশ্য। অর্থাৎ দুনিয়ার আসমান ও যমীনের ধ্বংসের পর পরকালে আল্লাহ যে আসমান ও যমীন সৃষ্টি করবেন তা হবে চিরস্থায়ী। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘যেদিন পরিবর্তিত করা হবে এ পৃথিবীকে অন্য পৃথিবীতে এবং পরিবর্তিত করা হবে আকাশসমূহকে’ (ইবরাহীম ৪৮)।
উক্ত আয়াতের শেষাংশে ‘আল্লাহ যদি অন্য কিছু চান’ দ্বারা পাপী মুমিনদের বুঝানো হয়েছে। যারা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জাহান্নামে শাস্তি ভোগের পর জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে (তাফসীর ইবনু কাছীর হূদ ১০৭ ও ১০৮ আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রঃ)।
উল্লেখ্য যে, একটি জাল হাদীছে এসেছে যে, ‘একদিন জাহান্নামের অবস্থা এমন হবে যে, সেখানে একজন আদম সন্তানও আর অবশিষ্ট থাকবে না’ (ইবনুল জাওযী, কিতাবুল মাওযূ‘আত ৩/২৬৮ ‘জাহান্নাম খালি হয়ে যাওয়া’ অনুচ্ছেদ)। উক্ত জাল হাদীছ দ্বারা দলীল গ্রহণ করা যাবে না। মোটকথা, কাফের-মুশরিকরা চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামে থাকবে। তবে ঈমানদার পাপীরা তাদের পাপের শাস্তি ভোগের পর রাসূল (ছাঃ)-এর শাফা‘আতক্রমে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে।
Video Source 1
Video Source 2
Video Source 3
কৃতজ্ঞতায়ঃ
ikhlasbd
at-tahreek