এক ওভার বল করে কেউ বোলার হয় না। এক বেলা রান্না করে কেউ বাবুর্চি হয় না। একদিন ঘাস খেতে দিয়ে, গরুর কাছে সারা বছর দুধ আশা করা যায় না। অথচ তুমি একরাত পড়েই পাশ করে ফেলতে চাও? দিনে এক ঘন্টা সময় না দিয়েই, এক একটা সাবজেক্টের সবকিছু বুঝে ফেলতে চাও? সারা বছর ফাঁকিবাজি করেও ভালো ভার্সিটিতে চান্স পেতে চাও?
শুনো, বৃষ্টি একদিন হলে তাকে বর্ষাকাল বলে না। অফিসে দুইদিন হাজিরা দিলে, সারা মাসের বেতন পাওয়া যায় না। বেতন পেতে হলে অফিসের কাজ প্রতিদিন করতে হবে। বোলার হতে হলে ম্যাচের পর ম্যাচ বলে করে যেতে হবে।
অথচ, আমরা বোলিং ছেড়ে দিয়ে, পিচের উপর দোষারোপ করি। ঘাস খেতে না দিয়ে, গরুর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনি। ঠিক জায়গায় ময়লা না ফেলে, এলাকা নোংরা বলি। সেজন্যই বইখাতাকে চিমটি না কেটে- মনোযোগ আসে না, বুঝতে পারিনা, ভালো লাগে না, এসব অজুহাত পেশ করি। তারপর জ্যামে আটকা পড়ে, বিরক্ত হয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফেইসবুকিং করি কিন্তু ব্যাগ থেকে বই বের করে এক মিনিটও পড়ার ইচ্ছা করি না। পাঁচ মিনিট পর পর খেলার আপডেট বন্ধুকে জিজ্ঞেস করতে পারি, কিন্তু সূত্রের প্রমাণটা একটু বুঝিয়ে দিতে বলতে পারি না। ইউটিউবে সারাদিন গান শুনতে পারি কিন্তু খান একাডেমীর দুই-একটা ভিডিওতে ক্লিক করতে পারি না।
দিনে ২৫০বার মোবাইল চেক করার নেশা ধরিয়ে দিয়ে, গড়ে প্রতিদিন সাড়ে চার ঘন্টা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যয় করিয়ে, ফ্রি নিউজ, মজার ট্রেলার দেখিয়ে তোমাকে আনন্দ দিচ্ছে না। তোমার সময় কেড়ে নিচ্ছে। তোমার স্বপ্নটা হাতছাড়া করে দিচ্ছে। ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথেই নোটিফিকেশন দিয়ে ওদের পথে ডেকে নিচ্ছে। দিনে দিনে তথ্য-প্রযুক্তি যত সহজলভ্য হচ্ছে, মূল লক্ষ্য থেকে সরে যাওয়া তত ইজি হচ্ছে। কানেক্টেড থাকার নাম করে, সময় নষ্ট করার নেশা ধরিয়ে দিয়ে, স্বপ্নগুলিকে গলা টিপে হত্যা করছে।
এখন টিকে থাকতে হলে- নেশা আর ইচ্ছার মধ্যে ছোট্ট একটা সংগ্রাম চালাতে হবে। ক্ল্যাশ অফ ক্লান্স, ফেইসবুকিং, খেলা দেখার নেশা যখন ডাক দিবে, তখন নেশাটাকে জোর করে পাঁচ মিনিট পিছিয়ে দিতে হবে। নেশা ছাড়বা না। জাস্ট পাঁচ মিনিট পিছিয়ে দিবা। তারপর সেই পাঁচ মিনিটে তোমার ইচ্ছা বা স্বপ্ন রিলেটেড কাজ করবা। এই রকম নেশা আর ইচ্ছার যুদ্ধ এক সপ্তাহ চালিয়ে যদি ৬০% সফল হতে পারলে, তোমার লাইফ আবার লাইনে আসা শুরু হবে।
লেগে থাকতে পারার নামই সফলতা:
যে সাবজেক্টটা কঠিন বলে, তুমি ফেল করেছ। সেই একই সাবজেক্টে, তোমার ক্লাসের অর্ধেকের বেশি পোলাপান ৬০ এর উপরে মার্কস পেয়েছে। যে বৃষ্টির কারণে, যে ঠাণ্ডার ভয়ে তুমি ঘর থেকে বের হওনি। সেই একই বৃষ্টিতে ভিজে, একই ঠাণ্ডায় কেপে কেপে, রিক্সাওয়ালারা ঠিকই সংসার চালানোর টাকা কামিয়ে ঘরে ফিরেছে। যে শহরে ঘুষ, অনিয়ম আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে বিজনেসে নামার স্বপ্নটা মাটি চাপা দিয়ে রেখেছো। সেই একই শহরে তোমার পাশের ফ্ল্যাটের একজন, ব্যবসায় নেমে ঠিকই এগিয়ে গেছে। সো, সমস্যাটা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, শীতের ঠাণ্ডা কিংবা সাবজেক্ট কঠিন হওয়ার মধ্যে না। সমস্যাটা তোমার মধ্যে। তবে সে সমস্যাটা তোমার স্বপ্ন, সাহস, চেষ্টার কমতি বা সময়ের অভাবের মধ্যে না।
শুনো, যে সিগারেট ছাড়তে চায়, সে সিগারেট ছাড়তে পারে না। যে সামনের সেমিস্টারে দুনিয়া উল্টায় ফেলতে চায়, সে সেই সেমিস্টারেও আগের সেমিস্টারের মতো লাড্ডু মারে। তাই সিগারেট ছাড়ার স্বপ্ন বাদ দিয়ে, আজকে দুপুরে লাঞ্চ শেষ করে সাথে সাথে সিগারেট না ধরিয়ে, ৫ মিনিট পরে সিগারেট জ্বালানোর টার্গেট সেট করতে হবে। পরেরদিন ঠিক একই কাজ করার চেষ্টা করতে হবে। পুরা সেমিস্টার পড়ে তাল গাছে উঠে যাওয়ার চিন্তা না করে, ক্লাস লেকচার শেষ হওয়ার সাথে সাথে, ক্লাস লেকচারের একটা টপিক নিয়ে ৫ মিনিট বসে বসে বুঝার চেষ্টা করতে হবে।
কেউ যুদ্ধ জয় করে না, একজন একজন করে শত্রুপক্ষের সৈন্যকে পরাজিত করে। কেউ সাগর পাড়ি দেয় না, বৈঠা মেরে মেরে, ইঞ্চি ইঞ্চি করে সামনে এগুতে থাকে। কেউ বিশ্ব সেরা খেলোয়াড় হয় না, একটার পর একটা ম্যাচে, দুই-একটা করে গোল করতে থাকে। সফলতা কোন লটারি না। জন্মদিনে প্রেমিকার উপহারও না। সফলতা হচ্ছে- কনসিসটেন্সি (ধারাবাহিকতা)। এই কনসিসটেন্সি, রেজাল্ট বা আউটকামের কনসিসটেন্সি না। এইটা চেষ্টার কনসিসটেন্সি। লেগে থাকার কনসিসটেন্সি।
মানুষের চেষ্টা হচ্ছে পানির মতো। চান্স পাইলেই গড়িয়ে নিচে নেমে যাবে। রিলাক্স করার কোন পাত্র পাইলে, সেই পাত্রের আকার ধারণ করবে। আরো বেশি চান্স পাইলে, নদীর স্রোতের সাথে ভেসে ভেসে বঙ্গোপসাগরে নিয়ে তোমারে ডুবাবে। তাই রিলাক্স হইও না। লম্বা টার্গেট সেট করো না। বরং নেক্সট স্টেপের দিকে তাকাও। সেই ছোট স্টেপটাই নিয়মিত দিতে থাকো। দেখবা, ছোট ছোট স্টেপ, পানির পাম্পের মতো তোমার চেষ্টার পানিকে একটু একটু করে উপরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এই একটু একটু করে এগিয়ে যেতে থাকলেই, একসময় পাহাড়ের চূড়া এসে তোমার পায়ের নিচে শিস বাজাবে।
লেখকঃ Jhankar Mahbub