ভালোবাসার অভিমান

2

মেয়েটা একবেলা পেরিয়ে গেছে, একটাও কথা বলেনি ছেলেটার সাথে। ঠিক গাল ফুলিয়েছে কিনা তাও বোঝা যাচ্ছে না। একটানা সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়েছে, লাইব্রেরিতে বসে প্র্যাক্টিক্যাল খাতা লিখেই যাচ্ছে। বাসায় ফেরার নাম নেই। ছেলেটা সারাদিন অনেক ঘুর ঘুর করেও একটা কথাও বলাতে পারেনি মেয়েটাকে। কি নিয়ে রাগ করেছে বলছেও না। ছেলেটাকে একদম না দেখার ভান করে একমনে লিখেই যাচ্ছে। নাওয়া খাওয়ারও খবর নেই।
শেষে মহা বিরক্ত হয়ে ছেলেটাচলে গেল লাইব্রেরি থেকে। দুদ্দার পা ফেলে জেদ দেখিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ঝাঁঝ মেশানো গলায় বলে গেল, “তুমি থাকো তোমার মত। পড়ো, লেখো, আরো আতেল হও! আমার সাথে কথা বলা লাগবে না!”
মেয়েটা মুখও তুলে তাকালো না। নির্লিপ্ত মুখে লিখেই যাচ্ছে। যেন ছেলেটা বায়বীয় পদার্থ! দেখা যায় না!

বেশ খানিক পর লাইব্রেরি বন্ধ হওয়ার সময় বই খাতা গুছিয়ে লাইব্রেরি থেকে বের হতে যাবে মেয়েটা, পুরো লাইব্রেরিতে আর কেউ নেই, বুড়ো লাইব্রেরিয়ান ছাড়া।
দরজা দিয়ে বের হতে নেবে, এমন সময় বুড়ো লাইব্রেরিয়ান ডাক দিল, “এই যে মামণি?”
ফিরে তাকালো মেয়েটা, “জ্বি? আমাকে বলছেন?”
ভারি চশমার ওপর দিয়ে তাকিয়ে সামনের টেবিলের দিকে ইশারা করলেন, “তোমার বন্ধুটা এই টিফিন বাটিটা রেখে গেছে কিছুক্ষণ আগে। তোমাকে দিতে বলেছে।”
অবাক হয়ে তাকায় মেয়েটা টেবিলের ওপর রাখাআইসক্রিমের বাটিটার দিকে। বাটিটা তারই। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভরা রয়েছে কিছু দিয়ে। ওপরু কস্টেপ মেরে একটা কাগজ আটকানো।
মেয়েটা বিস্মিত ভাবটা কোনমতে চেপে বাটিটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো। কে রেখে গেছে বলে দিতে হবে না তাকে, সে জানে। প্রায় দুদিন পর পরই নুডলস রেঁধে এই বাটিতে করেই ছেলেটাকে দেয় সে। ওর হাতের নুডলস রান্নার মহা ভক্ত ছেলেটা। যদিও যে খুব ভাল রাঁধে সে, এমন কিছু না। তবু ছেলেটা বিশাল বাটি গপগপ করে খেতে খেতে প্রায়ই মেয়েটিকে বলে, “এত জঘন্য রান্না জীবনে খাইনি। নষট করলে আল্লা গুনাহ দিবে দেখে খাই আরকি। রান্না শিখতে পারো না আন্টির কাছে? না শেখালে আমাকে বলবে, আমি ওনাকে চিঠি লিখবো, মেয়েকে রান্না বান্না এখনই সময় থাকতে শেখান, নাহলে রান্না খেয়ে জামাই মরে যাবে!”
মেয়েটা এসব শুনে কেবল সরল মুখে হাসে। উত্তর দিতে পারে না।
লাইব্রেরির বারান্দায় মিটমিটে হলদে বাতির নিচে এসে দাঁড়িয়ে বইখাতা ব্যাগ সামলে বাটিটার ঢাকনা সামান্য ফাঁক করে উঁকি দিল। ছেলেটাও নুডলস রেঁধে নিয়ে এসেছে আজকে তার জন্য। গন্ধ খারাপ হয়নি। তবে কিছু একটা বাদ গেছে মনে হচ্ছে, মশলা দেয়নি বা কম দিয়েছে হয়তো।
ওপরের কাগজটা টেনে খুলে ম্লান হলদে আলোয় মেলে ধরলো, “ওহে আঁতেল? পড়তে পড়তে আর লিখতে লিখতে হয়তো দেখা যাবে মাথার স্ক্রু খুলে গিয়ে মাথাটাই সকেট থেকে খুলে ঝুলছে। খাওয়া দাওয়াও তো সব বাদ দিয়েছো দেখলাম। দেখো, আমার ওপর ক্ষেপে গিয়ে লাভ নেই। এর থেকে আমার হাতে বানানো স্পেশাল নুডলস খাও। আর রাগ কমাও। একশো টাকা বাজি, সেই একখান ডিশ হয়েছে টুনি! চেখে দেখো! আমার আবার সব সময় রান্নার মুড আসে না! সম্রাট আওরঙজেব এই রেসিপির নুডলস খাইতেন বলে আমার কাছে নির্ভরযোগ্য তথ্য আছে!”
একটা নিঃশ্বাস ফেলে নুডলস গুলোর দিকে আরেকবার তাকাল মেয়েটা। একটা চামচের হালকা অবয়ব বোঝা যাচ্ছে। নুডলসের সমুদ্রের নিচে ডুবে গেছে। কাগজটার দিকে আবার তাকালো,
নিচে ছোট্ট একটা ছড়া লেখা-

“তুমি এত কঠিন কেন?
পাথর থেকেও শক্ত লাগে,
চুপ থেকেও হাজার গলায়
ডাকলে যেন একটু আগে!
তুমি এত মিষ্টি কেন?
পিঁপড়েরা সব কোথায় থাকে?
রান্নাঘরের কোন বোয়মে
আন্টি তোমায় লুকিয়ে রাখে?
তুমি এত সত্যি কেন?
মিথ্যে সবই আমার লাগে,
এমন করে কেউ চাবে না
সবটা দিয়ে তোমার ভাগে।
তুমি এত মেঘলা কেন?
রোদ লুকিয়ে লাভ কি হবে?
বৃষ্টি হয়ে উঠোন-পুকুর
ভালবাসায় ভাসবে কবে?”

লাইব্রেরির বারান্দার পাশে সিঁড়িতে বসে রাত দশটার সময় দেখা গেল মেয়েটা চামচ বের করে নুডলস খাচ্ছে বুভুক্ষের মত। আর হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছছে। ভারি অদ্ভুদ লাগে দেখতে।

#অনুগল্প_টোনাটুনি
মোঃ ফরহাদ চৌধুরী শিহাব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here