বোতলব্রাশ ফুল , এবং একটি বোকা পরী

6

আকাশ থেকে নেমে এলো ছোট্ট একটি প্লেন
সেই প্লেনে বসে ছিল লাল টুকটুকে মেম…
মেমকে আমি কোশ্চেন করলাম , হোয়াট ইজ…”
“আহহা পরী … একশবার বলেছি না , আমাকে মেম বলে ডাকবে না ?”
ধমক খেয়ে প্রত্যেকবার থেমে যেতাম আমি । এই ছোট্ট ছড়াটার প্রথম তিন লাইন বলে শেষ না করতেই কিয়ন রেগে লাল বেগুনি হয়ে যেত । প্রথম প্রথম আমি বেশ ভড়কে যেতাম , আরে সামান্য একটা ছড়াই তো কেটেছি – একটু দুষ্টুমি করে মেমই না হয় বলেছি , এতে এমন রাগের কি হল ? পরে দেখি , নাহ , এই তুষারশ্বেতা রাজকন্যার মত সুন্দর ছেলেটা নিজেকে আসলে সুন্দর ভাবতে চায়না । এর চেয়ে আমি যদি তাকে হুতোম পেঁচা ডাকি, তাহলেই বরং সে খুশি !
কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আমার ঘাড়ের তিনটা রগই ত্যাড়া । তার উপর কেউ সহজে রেগে গেলে তাকে রাগাতেও আমার অসম্ভব ভাল লাগে , তাই একটু একটু করে কিয়নের ঝাড়ি খাওয়াটাও আমার কাছে প্রতিদিনের অভ্যাস হয়ে গেল । আর এভাবে ঝাড়ি দিতে দিতে কিয়নও একসময় হালকা হয়ে গেল – শুধু ফোঁস করে একটা দম ফেলে সে বলত ,
“ আচ্ছা পরী , খুব ভাল লাগে এমন করতে ?”
আমি ভেংচি কেটে বলতাম , “ লাগেইতো ! মেনে নিয়েছ না আমাকে ?”
অথচ এত বিরক্ত করবার পরেও আমাকে ছাড়া এই ছেলেটা কিংবা এই ছেলেটাকে ছাড়া আমি থাকতে পারতাম না । কারন আমার স্বভাবের পুরোপুরি বিপরীতে বাঁচা এই মানুষটিকে আমি যে ভীষণ ভালবাসতাম ! আর সেই ভালবাসার পরিমাণ অনেকটা ঠিক অসম্ভবের কাছাকাছি ।
তুষার দিয়ে বানানো পুতুলের মত দেখতে এই ছেলেটার ভেতর এত রাগ কেমন করে চাপা থাকত , আমার এই বোকা বুদ্ধি দিয়ে আমি সেটা কোনদিন বুঝতে পারতাম না । মাঝে মাঝেই ওর দিকে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম – এই মানুষটাই কিনা এতগুলো বোতলব্রাশ ফুল তুলে নিয়ে এসে আমাকে ভালবাসার কথা বলেছিল ! ভাবা যায় ?
আমাকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিয়ন একটু চমকে যেত । এদিক ওদিক তাকিয়ে বলত,
“ কি দেখছ ?”
“তোমাকে ।”
“ কেন ?”
“ তোমার মত হোমো স্যাপিয়েন্স আমি তো আর একটাও দেখিনাই । তাই তোমাকেই দেখছি ।”
“ কি যে বল । এই পৃথিবীতে কেউ আবার কারো মত হয় নাকি ?”
“ তোমার মত যে হয়না , সেটা তো জানি ।”
“ কেন ? বোতলব্রাশ ফুল দিয়ে প্রপোজ করেছিলাম বলে ?”
“ উহু” বলে মাথা নাড়াই আমি । তারপর কিয়নের বড় বড় চোখের দিকে তাকিয়ে বলি, “ আর কারো হৃদপিণ্ডের অলিন্দ নিলয় দিয়ে বরফ আসা যাওয়া করেনা বলে ।”
কিয়ন হাসবেনা হাসবেনা করেও হেসে ফেলত । আর আমি তালগোল পাকিয়ে ভাবতে বসতাম – যেসব মানুষকে হাসলে এমন অমানবিক সুন্দর দেখায় , তারা এত কম হাসবে কেন ?
বেশিরভাগ সময়েই কিয়নকে আমার অচেনা লাগত । মনে হত , এই অসম্ভব শীতল মনের মানুষটির নিঃশ্বাসে বোধ হয় গ্লাসে রাখা পানিও বরফ হয়ে যাবে । তাই সব মায়া বাদ দিয়ে তার উপর ভীষণ রেগে থাকতে ইচ্ছে করত আমার । কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এই ছেলেটার উপর অতিরিক্ত মেজাজ খারাপ হওয়াটাও আমার জন্য বিপজ্জনক ছিল ।
আচ্ছা পাঠক , কখনো কি এমন শুনেছেন – যার উপর খুব রেগে আছেন , হুট করেই সেই মানুষটার উপর মায়া লেগে যাচ্ছে ? এবং সেটা নিতান্তই অসময়ে ? সেটা আবার যে সে মায়া নয় , সেই মায়াতে কান্না চলে আসে – এমন ? আমার এমন হত । আমার রাগ হতে থাকা চোখ দেখেই সে কিভাবে যেন বুঝে ফেলত । তারপর গালে হাত দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলত , “ পরী , তুমি রাগ করলে আমি কোথায় যাব ?”
আমি তখন এই নির্বোধ মনটা দিয়ে সেই কান্না চেপে রাখতাম – দুই হাত দিয়ে তার মুখটা চেপে ধরে বলতাম – “ তুমি একটা পাগল ! পা… গ… ল… !”
সব ভালবাসাই কি একইরকম বিচ্ছিরি – নাকি শুধু আমারটাই ?
কিন্তু তবুও তো আমি আমার এই ভালবাসাকে মেনে নিয়েছিলাম । এই বিচ্ছিরি ভালবাসা নিয়েই আমি নাহয় এই একটা জীবন তোমার সাথে কাটিয়ে দিতাম , কিয়ন । তাহলে আমার বিচ্ছিরি জীবনটাকে তুমি একলা করে দিয়ে গেলে কেন ?
কিয়ন যেদিন মিলিটারিতে চলে গেল – আমি সেদিন তাকে বিদায় দিতেও যাইনি । এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকবার জন্য মানুষ তো কত রকম কাজ করে , তোমাকে মিলিটারিতে যেতে হবে কেন ?

“ মিলিটারি ট্রেনিং খুব কষ্টের , তুমি জানোনা ? তোমার ওসব করতে যেতে হবে না ।“
“ পরী , তুমি কবে থেকে আমাকে মোমের পুতুল ভাবো ?”
“ ভাবিনা !” আমার চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি পড়তে লাগল , “ আমি জানি , তুমি মোমের পুতুল না , তাই আমি তোমাকে চোখের সামনে রাখতে চাই । যেন তোমার কারণে তোমার কোথাও আঘাত না লাগে !”
“ আমি চলে গেলে তুমি উড়ে যাবে পরী ?”
“ তুমি যেও না !”
কিয়ন খুব ছেলেমানুষি হাসি দিয়ে আমার চুলগুলো এলোমেলো করে দিল – হেসে হেসে বলল , “ যেদিন আমাকে মিস করাটা তোমার কাছে সকালে দাঁত ব্রাশ করবার মত নরমাল হয়ে যাবে, ঠিক সেরকম একটা দিনে আমি তোমার কাছে ফিরে আসব । আমার নোঙ্গর তোমার উঠোনে বাঁধা থাকল পরী , তুমি উড়ে গেলেও আমি তোমাকে খুঁজে নেব !”

কিয়নকে আমি বাঁধা দিতে পারিনি , সে ঠিকই চলে গিয়েছিল । মিলিটারির অদ্ভুত গতবাধা নিয়মের জন্যই কিনা জানিনা , তার সাথে আমার যোগাযোগ প্রায় থেমে গেল । মাঝেমাঝে আমি তার কাছ থেকে দুই একটা চিঠি পেতাম , কিন্তু মাস ছয়েক পর তাও বন্ধ হয়ে গেল । আমি শুধু দম আটকে তার জন্য অপেক্ষায় থাকতাম । এতকিছুর পরেও ধমনীতে বরফ নিয়ে বেঁচে থাকা এই মানুষটাকে মিস করা আমার অভ্যাসে পরিনত হল না ।

মাঝেমাঝে প্রচন্ড আতংকে আমার হৃদ স্পন্দন থেমে যেতে চাইত । আচ্ছা, কিয়ন কি আমাকে ভুলে গেল ? চারদিকে আমার যখন আঁধার আঁধার অবস্থা, আমি তখন নিজেই নিজেকে থামাই । আমি হারাই , আমি ফিরি – আমি চোখ বুজি , আমি চোখ মেলে তাকাই । আমার চোখের শেষ বিকেলে গাঢ় হতে থাকে তার ছায়া , একটু একটু করে । এই আমিতো নিজের অস্তিত্বে নিজেই নিভে যাচ্ছি – কিয়ন , তুমি কিনা আমাকে ভুলে যাবে ? পারলে যাও !
এভাবেই দিন যেতে লাগল – তারপর বছর ঘুরে আজ আমার জন্মদিন । ঘুম থেকে উঠে আমি আবিষ্কার করলাম , কিয়ন নামের সেই তুষার শুভ্র মানুষটির জন্য আমার আর আজকে প্রান কাঁদছে না । এই এক জীবনে যে মানুষটিকে আমি আমার সবটুকু দিয়ে ভালবেসেছি , সে আমার পাশে থাকবেনা – এর চেয়ে স্বাভাবিক ঘটনা আমার কাছে যেন আর কিছু হতেই পারেনা !

ঠিক মাঝদুপুরের শেষে আমার বাড়ির উঠোনে আচমকাই একটা কলিংবেলের আওয়াজ । আমি নিতান্তই আনমনে দরজা খুলতে যাই – তাকিয়ে দেখি , দরজার ওপাশটায় আমার পায়ের সামনে এক ঝাঁক বোতলব্রাশ ফুল । এরকম একটা দিনে এমন রসিকতা আমার সাথে কে করতে পারে ?
আমি চোখ তুলে তাকাই । আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে আমি কিছুতেই চিনতে পারি না । এই অসম্ভব সুন্দর মানুষটিকে আমি যেন কখনো দেখিনি !

আমি অবিশ্বাসের চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকি । আমার চোখের সামনেই আমাদের স্মৃতিগুলো একটু একটু করে দেয়াল তুলতে থাকে । আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখি, সেই দেয়ালের রঙ স্বচ্ছ – ঠিক যেন স্ফটিকের মত । সেই স্বচ্ছ দেয়ালের ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে আমার এতই বাস্তব মনে হল, যেন হাত বাড়ালেই আমি বুঝি তাকে ছুঁয়ে দিতে পারব । কিন্তু না , আমি ভীষণ শক্ত করে নিজের হাতটা চেপে ধরে বলি – না , পরী , না !
আমি এক পা পিছিয়ে যাই – আমি দুই পা পিছিয়ে যাই । আমার চোখের আলো একটু একটু করে ঝাপসা হয়ে আসে । যেই বাতাস আলতো করে তার চুল ছুঁয়ে যাচ্ছে, এই মুহুর্তে সেই একই বাতাস কি আমার উষ্ণতা কেড়ে নিচ্ছে ? আমি আর এক মুহুর্তও অপেক্ষা না করে পেছন ঘুরে ফিরি । এই পৃথিবীতে যার কান্নার দাম তার কাছে সবচাইতে কম , সেই বিষণ্ণ কান্না নিয়ে আমি তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে চাইনা !
আমি প্রানপনে প্রার্থনা করতে থাকি , সে যেন আর কোনদিন আমার নাম ধরে না ডাকে । তাকে আমি আর চাইনা , কোনদিন না , কক্ষনো না – তবুও আমার মনে হতে থাকে, সে আমাকে একবার ডাকলেই আমি বুঝি আমার সব শক্তি এক করেও তাকে ফেরাতে পারব না !
আমি নিজের মাঝে লুকোতে গিয়ে অসহায়ের মত আবিষ্কার করি , মানুষের অনুভূতি কতটা মর্মান্তিক হতে পারে । মানুষের অনুভুতি কতটা মর্মান্তিক রকমের বিচ্ছিরি হতে পারে !

আমি পেছন ঘুরতেই কিয়ন তার ভরাট গলায় আমাকে ডেকে বলল ,
“ পরী ! শুভ জন্মদিন !”
আমি সামনে ফিরে তাকালাম । সে এক পা এক পা করে এগিয়ে এসে বলল,
“ দেখেছ , আমার না থাকাটা তোমার কাছে এখন অভ্যাসের মত হয়ে গেছে !”
“ কোন অভ্যাসের কথা বলছ ? যে অভ্যাস আমাকে মৃত মানুষ বানিয়ে গিয়েছে ?”
“পরী…” কিয়ন এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল , “ আমি আর তোমাকে একা ফেলে যাব না …”
“ মিথ্যে !”
“ না সত্যি ! এই যে দেখ …” সে নিচু হয়ে বোতল ব্রাশ ফুলগুলো তুলে নিয়ে বলল , “ আমাদের সম্পর্কে যে ধুলো জমে গিয়েছে , এই বোতলব্রাশ ফুল দিয়ে সব একদম ঝেড়ে ফেলব … ঠিক আছে পরী ?”

আমি তবুও বিশ্বাস করতে পারিনা । আমার মনে হল , এটা বুঝি আমার ভোরের স্বপ্ন । যে স্বপ্ন সত্যি হবে বলে আমি এতগুলো দিন সারারাত না ঘুমিয়ে ভোরের আগে ঘুমোতে যেতাম !

কিয়ন এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে ঠিক আগের মত আমার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল ,
“বলেছিলাম না , আমি ঠিক ফিরব ? “
আমি চোখ ভরা পানি নিয়ে কিয়নের দিকে তাকিয়ে থাকি । এই মানুষটিকে ছাড়া আমার কি সত্যিই কোন উপায় আছে ?
বোতলব্রাশ ফুলের মত আজগুবি ফুল দিয়ে যেসব ছেলেরা ভালবাসার কথা জানায় , তারা যেন আসলেই কেমন কেমন হয় । তাদেরকে একটুও পাত্তা দেয়া উচিত না … একটুও না ……

2 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here