আমি বাবার প্রেসক্রিপশন আর রেনিটিডিন ঔষধের পাতাটা হাতে নিয়ে ভাইয়ার রুমে গেলাম। রুমে ঢুকে দেখি ভাইয়া বিছানায় শুয়ে ফোন টিপছে আর ভাবী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছে। আমাকে দেখে ভাইয়া বললো,
– কিরে, কিছু বলবি?
আমি তখন বললাম,
— ভাইয়া তুমি হয়তো ভুল করে ফেলেছো। প্রেসক্রিপশনে ডাক্তার সারজেল ট্যাবলেটের কথা লিখেছে তুমি ভুল করে রেনিটিডিন ঔষধ নিয়ে এসে পরেছো
আমার কথা শুনে ভাইয়া বললো,
– আমি ভুল করে না, জেনেই এনেছি। দুইটাই তো গ্যাসের ট্যাবলেট। কাজ যেহেতু দুইটার একই সেহেতু শুধু শুধু দামী ঔষধ কিনে টাকা নষ্ট করার মানে নেই
ভাবী আয়নার দিকে তাকিয়ে থেকেই বললো,
~শুধু যে দামী ঔষধ ভালো হবে তা কিন্তু না। মাঝে মধ্যে কমদামী ঔষধও ভালো কাজ করে
আমি আর কিছু না বলে চুপচাপ ভাইয়ার রুম থেকে বের হয়ে আসলাম। ভাইয়া আগে এমন ছিলো না কিন্তু বিয়ে করার পর থেকেই ভাইয়া এমন হয়ে গেছে
বাবার রুমে এসে দেখি বাবা খবরে কাগজ পড়ছেন। খবরের কাগজের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হয়ে বাবাকে বললাম,
— দুইদিনের আগের পত্রিকা পড়ে কি মজা পাচ্ছো? তারচেয়ে বরং আজকেরটা পড়ো
বাবা পত্রিকার কাগজ থেকে মুখটা সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে শুধু একটু মুচকি হাসলো। বাসায় বসে থেকে দম বন্ধ লাগছিলো তাই ভাবলাম বাহির থেকে একটু হেঁটে আসি। বাসার সামনে যেতেই খেলায় করলাম হকার ছেলেটা পাশের বাসায় ঠিকিই পত্রিকা দিলো কিন্তু আমাদের বাসায় না দিয়ে চলে যাচ্ছিলো। আমি ছেলেটাকে ডাক দিয়ে বললাম,
— কিরে, আমাদের বাসায় পত্রিকা না দিয়েই চলে যাচ্ছিস যে?
হকার ছেলেটা বললো,
– খালুজানতো বলেছে প্রতি শুক্রবার শুধু খবরের কাগজ দিতে
আমি অবাক হয়ে বললাম,
— বাবা তোকে কবে এই কথা বললো?
ছেলেটি বললো,
– তিনদিন আগে বলেছে
আমি কিছু না বলে চুপচাপ বাবার রুমে গিয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম,
— তুমি নাকি পত্রিকার ছেলেটাকে বলেছো শুধু শুক্রবারে পত্রিকা দিতে?
বাবা মুচকি হেসে বললো,
~আর বলিস না শুক্রবারে যে খবরটা ছাপা হয় পুরো সপ্তাহ জুড়ে শুধু এই খবরটাই ঘুরিয়ে পেছিয়ে লেখা হয় তাই বলেছি শুধু শুক্রবারের পত্রিকাটাই দিতে। শুধু শুধু টাকা নষ্ট করে লাভ নেই
আমি যা বুঝার বুঝে গিয়েছিলাম। ভাইয়া নিশ্চয়ই বাবাকে কিছু বলেছে তাই বাবা খরচ বাঁচাচ্ছেন। আমার কিছু করার ছিলো না তখন কারণ ইন্টার পড়ুয়া একটা ছেলে তখন কিবা করতে পারে
রাতে খাবার টেবিলে বসে সবাই যখন খাচ্ছি তখন ভাবী ভাইয়াকে ইশারা করলো বাবাকে কিছু একটা বলার জন্য। ভাইয়া তখন বাবাকে বললো,
– বাবা, তুমি কিছু মনে না করলে একটা কথা বলতাম। আসলে আমাদের রুমটা খুব ছোট হয়ে গেছে। তুমি তো একাই থাকো তাই তুমি যদি আমাদের রুমে এসে পরতে আর তোমার রুমটা আমাদের দিয়ে দিতে তাহলে খুব ভালো হতো বাবা তখন অসহায়ের মত ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
~আমি আর তোর মা ২৮টা বছর এই রুমটাতে কাটিয়েছি। এখন তোর মা বেঁচে নেই কিন্তু এই রুমটার ভিতর ঘুমালে মনে হয় তোর মা আমার সাথে আছে
বাবার কথা শুনে ভাবী কাঁশতে লাগলো তখন ভাইয়া বাবাকে বললো,
— ঠিক আছে বাবা, তুমি তোমার রুমেই থেকো কিন্তু তোমার রুমের এসিটা আমায় দিয়ে দাও কারণ তৃনার(ভাবী) হাই প্রেসারের একটু সমস্যা আছে তাছাড়া তোমার তো এখন এসির দরকার পরে না
বাবা তখন নিচের দিকে তাকিয়ে বললো,
~আচ্ছা ঠিক আছে
আড়চোখে তাকিয়ে দেখি ভাইয়া আর ভাবীর মুখে বিজয়ের হাসি। মনে হচ্ছিলো ওরা যুদ্ধ জয় করে ফেলেছে। ইচ্ছে করছিলো ভাইয়ার মুখে থুথু মারি কিন্তু বড়ভাই বলে কথা।আজ যদি ছোটভাই হয়ে বড়ভাইয়ের মুখে থুথু মারি তাহলে কাল আমাকে নিয়ে বিচার বসবে আর সমাজ আমাকে দোষী বানাবে। তাই নিজের থুথু নিজের মুখেই রেখে খাবার টেবিল থেকে চুপচাপ উঠে চলে গেলাম…
কয়েকদিন পর আমি আর বাবা রুমে বসে কথা বলছি।হঠাৎ ভাইয়া রুমে এসে বাবার দিকে শপিংব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বললো,
-বাবা, তোমার আর পিয়াসের জন্য দুইটা পাঞ্জাবি কিনেছি। পরে দেখো তো তোমাদের ঠিক ঠাক হয় কি না
এই কথা বলে ভাইয়া অন্য রুমে চলে গেলো। বাবা পাঞ্জাবি গুলো বের করে ভালো ভাবে দেখে আমায় বললো,
~দেখলি তোর ভাইয়া আমার আর তোর জন্য কত দামী পাঞ্জাবি কিনে এনেছে। পাঞ্জাবি সম্পর্কে আমার অনেক ভালো আইডিয়া আছে। কম করে হলেও দুইটা পাঞ্জাবির দাম ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা হবে। তুই শুধু শুধু তোর ভাইয়াকে ভুল বুঝিস। নিজের রক্ত বলে কথা
এই কথা বলে বাবা পাঞ্জাবিটা পরলো। এমন সময় ভাবী আর ভাইয়া তড়িঘড়ি করে রুমে ঢুকলো। ভাইয়া বাবাকে বললো,
– সরি বাবা, আমি ভুল করে তোমাকে আর পিয়াসকে আমার শ্বশুর আর শালার জন্য কিনে আনা পাঞ্জাবি গুলো দিয়ে ফেলেছি। তোমাদের পাঞ্জাবি গুলো এইখানে
বাবা হাসতে হাসতে বললো,
~সমস্যা নেই। আমি আরো ভুল করে পরে ফেললাম
বাবা গা থেকে পাঞ্জাবিটা খুলে দিলে ভাইয়া আর ভাবী পাঞ্জাবিটা নিয়ে অন্য রুমে চলে যায়। আমি রেখে যাওয়া শপিংব্যাগ থেকে পাঞ্জাবি গুলো বের করে বাবাকে দেখিয়ে বললাম,
— তোমার মত পাঞ্জাবি সম্পর্কে আমার এত আইডিয়া না থাকলেও মোটামুটি একটা আইডিয়া আছে। দুইটা পাঞ্জাবি সর্বোচ্চ হলে ১০০০টাকা থেকে ১২০০ টাকা হবে। দিন শেষে দেখা যায় নিজের রক্তই বাবা বেঈমানী করে
বাবা কিছু বললো না শুধু জানালার গ্রীল ধরে বাহিরের আকাশটার দিকে তাকিয়ে রইলো…
—
—–
ভাইয়া অফিসের একটা কাজে চট্টগ্রাম গিয়েছিলো। এর মধ্যে হঠাৎ করে ভাবীর শরীর খারাপ হয়ে যায়। আমি ভাইয়াকে ফোন দিয়ে বললাম,
— ভাবীর শরীর খারাপ মনে হয় প্রসব ব্যথা উঠেছে। আমি ভাবীকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি
ভাইয়া তখন বললো,
– সরকারি হাসপাতালে না নিয়ে তুই প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যা। সরকারি হাসপাতালে ভালো চিকিৎসা হয় না
আমি আমতা আমতা করে বললাম,
— প্রাইভেট হাসপাতালে তো অনেক খরচ
ভাইয়া তখন বললো,
– যত টাকা লাগে আমি দিবো তুই আগে নিয়ে যা
হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর ডাক্তার কিছু ঔষধ দিলে আমি ভাইয়াকে ফোন করে বললাম,
— ভাইয়া, ডাক্তার যে ঔষধ গুলো দিয়েছে সেই একই ঔষধ গুলো অন্য কোম্পানির অনেক কম দাম। কাজ যেহেতু একই আমি অন্য কোম্পানির ঔষধ গুলো নিয়ে যাই? শুধু শুধু টাকা নষ্ট করে লাভ কি?
আমার কথা শুনে ভাইয়া রেগে গিয়ে বললো,
— তুই কি এমবিবিএস ডাক্তার? এত বেশি বুঝিস কেন? ডাক্তার যেগুলো দিয়েছে সেগুলোই নিয়ে যা। ভালো জিনিসের দাম একটু বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক
আমি আর কিছু না বলে মুচকি হেসে ফোনটা রেখে দিলাম
—
—–
ভাইয়া এই মুহুর্তে তার সন্তানকে কোলে নিয়ে বসে আছে। ভাইয়ার চোখে মুখে আনন্দের হাসি। ভাবীর এখনো জ্ঞান ফিরেনি। আমি ভাইয়ার কাছে গিয়ে বললাম,
— কোন বাবাই তার সন্তানের জন্য কৃপণতা করে না। সব বাবাই তার অবস্থান থেকে সবচেয়ে ভালোটা তার সন্তানকে দিতে চায়। কিন্তু সেই সন্তান যখন বড় হয় তখন কেন বাবার জন্য কৃপণতা করে বলতে পারো?
আমি ভাবীকে কোন দোষ দিবো না। ভাবী অন্য রক্তের তাই উনার আমাদের প্রতি টান না থাকাটাই স্বাভাবিক কিন্তু তুমি তো আমাদের রক্তের তুমি কি করে পারলে বাবার জন্য কমদামী ঔষধ আনতে, রুম থেকে এসিটা নিয়ে যেতে, বাবার গা থেকে পাঞ্জাবিটা খুলে নিয়ে যেতে? তুমি যেমন তোমার সন্তানের জন্য ছটফট করছিলে তেমনি আমার বাবাও তোমার আমার জন্য এমন ছটফট করেছিলো। সেই তুমি এতটা অকৃতজ্ঞ হতে পারলে?
ভাইয়া আমার কথা শুনে কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে রইলো। আমি তখন ভাইয়ার কাঁধে হাত রেখে বললাম,
— মনে রেখো, তুমিও ছেলে
সন্তানের বাবা হয়েছো
—
—-
হাসপাতালে বাহিরে এসে যখন রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছি তখন বাবা আমার পিছন থেকে হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
– চল, আজ বাবা আর ছেলে একসাথে কিছুটা পথ হাটি
হটার সময় খেয়াল করছিলাম বারবার বাবার সাদা গ্লাসের চশমাটা ঝপসা হয়ে যাচ্ছিলো। হয়তো বাবা কাঁদছিলো তাই। আচ্ছা আমিও কি ভাইয়ার মত অকৃতজ্ঞ সন্তান হবো। কি জানি, দিন শেষে আমিও হয়তো অন্যের রক্তের ঘ্রাণ পেয়ে নিজের রক্তকে অবহেলা করবো..