আমি সেই মেয়েটার গল্প বলি,
কালো শাড়ি আর কপালের ছোট্ট টিপে যার সরলতা মুগ্ধতাই ছড়িয়েছিল আকাঙ্খিত প্রহরে।
কাছে এসে সে বলেছিল,
হাতে হাত রেখে হাঁটবেন আমার পাশে? নাকি ছুঁয়ে দিতে সংকোচ বোধ করেন নিয়মের খেলায়?
আমি বলেছিলাম, আগে কপালের টিপটা তো ঠিক করো মেয়ে।
চোখে মুখে কপট রাগ এঁকে সে বলেছিল, বলতে হয়? ঠিক করে দিলেই তো হয়।
এক গাল হেসে অনভিজ্ঞ হাতে ঠিক করে দিয়েছিলাম টিপ।
পথ শেষ হয়ে গিয়েছিল, নীরবতা ভেঙ্গে বলা হয় নি কোনো কথা, তবু সব কথাই যেন পৌঁছে গিয়েছিল মন থেকে মনে।
একসময় বিদ্যুৎ চমকে উঠেছিল আকাশজুড়ে। সে হুট করেই ভয় পেয়ে মুখ লুকিয়েছিল এই বুকে, বলেছিল, আমায় আগলে রাখবেন এমন করে?
আমি কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না, শুধু মনে হচ্ছিল, এই মেয়েটার সাথে সারাজীবন কিছু না ভেবেই কাটিয়ে দেয়া যায়।
আচ্ছা, বৃষ্টিতে ভিজলে আপনার ঠান্ডা লাগবে না তো?,তার চোখে শন্কা দেখছিলাম আমি।
আমি যখন মাথা নাড়লাম, সে যে কি খুশি হয়েছিল! বলছিল, জানেন আমি প্রচুর বৃষ্টিতে ভিজতে পছন্দ করি। আম্মু বকা দেয় খুব এজন্য। আপনি কিন্তু একদমই বকা দেবেন না বলে দিলাম। আপনি আমার সঙ্গী হবেন বৃষ্টিতে ভেজার?
সে রাজি হওয়ার অপেক্ষা করে নি, তার ছেলেমানুষিতায় মনের অজান্তেই সায় দিয়েছিলাম সেদিন।
আমাদের গল্প এমন করেই এগিয়েছিল।
অদিতি নামের সেই মেয়েটা একদিন খুব সকালে ফোন দিলো। এমনিতে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে যাওয়া স্কুল জীবন থেকেই অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। সেদিনও উঠে গিয়ে বই পড়ছিলাম। ‘দ্যা এলকেমিস্ট’। “And, when you want something, all the universe conspires in helping you to achieve it.” পাউলো কোয়েনহোর লেখা অসাধারণ সব উক্তিতে ভরা উপন্যাসটায় বুঁদ থাকতে পারলাম না আর তার মিষ্টি গলা শুনে। “মাহতাব সাহেব, আজ আমার জন্মদিন। সময় হবে আমায় কিছুটা সময় দেয়ার?”
বিকেলটা তার নামে লিখেছিলাম সেদিন। সে অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিল ,’ কিছুই আনেন নি? এক মুঠো কৃষ্ণচূড়াও না? আপনি এত বোকা কেনো বলেন তো! হুহ রাগ করলাম কিন্তু। ‘
না সে রাগ করে নি। সে কখনোই চাওয়া পাওয়ার হিসেবে নিজেকে হারিয়ে ফেলে নি। তার ছোট্ট পাওয়াগুলোতেই মিশে থাকতো সন্তুষ্টি। আমায় কেন যেন টানতো এই ব্যাপারটা।
পার্কের বেঞ্চিতে তার কথার নীরব স্রোতা হয়ে ছিলাম সেদিন। এ কথা সে কথায় গোধূলীর আলো যখন বাড়ি ফেরার তাড়ায়, লুকিয়ে আনা এক রঙা চুড়িগুলো তার হাতে দিয়েছিলাম। দিয়েছিলাম তার প্রিয় কৃষ্ণচূড়া। সে কিছু বলতে পারে নি, আমি কেবল অশ্রুদের গড়িয়ে যাওয়া দেখছিলাম তার মায়াবী চোখগুলোয়।
আমার কাঁধে মাথা রেখে সে ছেলেমানুষিতায় হারাচ্ছিল যেন, ‘আচ্ছা আমি যে আপনাকে এত্ত জ্বালাই, আপনি বকা দেন না কেন আমায়? জানেন আমার খুব ভয় হয়, হুট করে একদিন যদি আপনাকে হারিয়ে ফেলি, যদি শহর থেকে শহরে হন্যে হয়ে খুঁজেও আপনার আর দেখা না পাই, আমায় এমন করে ভালবাসবে না কেউ আর, এটা মনে করেই আমার বুকটা শূণ্যতার মেঘে ভরে যায়। কথা বলেন না কেনও? আমায় একা করে দেবেন না তো কখনও?’
অদিতিকে সেদিন আমি কিছু বলতে পারি নি। শুধু একটুখানি আস্হার হাসিতেই যেন বলে দিয়েছিলাম না বলা সব কথা। আমি জানি প্রতিশ্রতির টানাপোড়েনে আজকাল সম্পর্কগুলোয় বিষাদের কালো ছায়া ঘিরে থাকে। জীবন আমাদের সুখ সহ্য করার মানুষিকতায় অভ্যস্ত হতে পারে না। তাই ভালোবাসায় ভালোলাগাটা আপেক্ষিক হয়ে যায় বোঝাপড়ার প্রশ্নে। তবু বেঁচে থাকে স্বপ্ন, পিছুটানকে পেছনে রেখেই এগিয়ে যেতে হয় ভালোবাসার মিছিলে।
আমাদের একসাথে বেঁচে থাকার গল্পে অভিমান ছিল, ছিল রাগ নামের বিষন্নতারাও। অদিতিও কারণে অকারণে রাগ করতো। কিন্তু সে প্রকাশ করতে চাইতো না। ভীষণ লুকোনো স্বভাবের মেয়েটাকে নিজের ভাবনাগুলো অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে যেমন দেখিনি কোনোদিন, তেমনি রেগে গিয়ে তাকে কখনোই বিষন্নমায়ায় জড়াতে দেখিনি, হয়ত সেই বিষন্নতা লুকিয়ে রাখতো সে, আড়ালে ঝরতো অশ্রু হয়ে, কিন্তু আমায় বুঝতে দেয় নি কখনও। তবে মাঝে মাঝে সেটা নিয়ন্ত্রণে রাখতো পারতো না বোধহয়। একবার হলো কি, দোকান থেকে সিগারেট কিনে বের হলাম, সে দেখে ফেললো। তারপর আর সারাদিন তার খোঁজ নেই। আমার মনে আছে, তার খোঁজে আমি তার হলের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম সন্ধ্যে অবধি। সে দেখা দেয় নি। আমায় কেমন যেন শূণ্যতা ঘিরে ধরেছিল চারপাশটায়। সব থেমে গিয়েছিলো, নিঃশব্দ জোনাকের মতো, অব্যক্ত অশ্রুধারার মতো কিংবা ঘাসের কোণায় জমে থাকা এক ফোঁটা শিশিরের মতো। এমনও হয়েছে, নিয়মিত ভোরটাকেও ভারী বিরক্তিকর লাগতো।
সেবারই প্রথম আমার মনে হয়েছিল, এই মেয়েটাকে কষ্ট দেয়াটা অন্যায়। আমি বোধহয় ভালোবেসে ফেলেছি অদিতিকে।
তিনদিন পর খুব সকালে অদিতির ফোন। ‘আপনি আমার সাথে এখনই দেখা করেন।’
আমি ছুটে গিয়েছিলাম, তার মলিন চোখে দেখেছিলাম কিছু একটা হারিয়ে ফেলার ভয়। সে আমার হাত খুব শক্ত করে ধরেছিল, যেন হাতটা ছেড়ে দিলেই আমি অদৃশ্য হয়ে যাবো তার সামনে থেকে। বলেছিল, জানেন সিগারেটের নেশা আমার বাবাটাকে বাঁচতে দেয় নি। ফুসফুসের ক্যান্সারে আমার বাবাটা কষ্ট পেয়ে পেয়ে শেষ হয়ে গিয়েছিল। এজন্য আপনার হাতে সেদিন সিগারেট দেখে পুরনো সেই খারাপ লাগাটা ফিরে এসেছিল। আমি আর হারানোর গল্পে নিজেকে দেখতে চাই না। আপনি আর সিগারেট ধরবেন না, আমায় ছুঁয়ে বলেন।
সেদিনের পর নিকোটিন আর আমার সাথে দূরত্ব তৈরি হতে শুরু করেছিল।
বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামলো বলে। এক পশলা বৃষ্টি ভিজিয়ে দিয়ে গেলো আমাকে। আমি অদিতির অপেক্ষার দাঁড়িয়ে আছি ওর ডিপার্টমেন্টের সামনে। পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে এসেই সে অবাক, ‘আপনি? বললেন না যে আসবেন?’
‘বললে কি আর সারপ্রাইজ দেয়া হতো? ‘
‘আচ্ছা, আজকে তাহলে মাহতাব সাহেবের সারপ্রাইজ দিতে ইচ্ছে হলো?’
আমি মুচকি হেসে দিলাম।
‘ক’দিন আগেই তো জ্বরটা গেলো। আবার তাকে ডাকার স্বাদ হয়েছে? ‘ সে তার ওড়না দিয়ে আমার মাথা মুছে দিল।
আমরা পাশাপাশি হাঁটছিলাম। বৃষ্টিশেষের হিমেল হাওয়ায় তার খোলা চুল উড়ছিলো, কপট বিরক্তি নিয়ে কপাল থেকে চুল সরানোতেই বোধহয় তার সমস্ত মনোযোগ। তার জন্যই হোচঁট খেয়ে পড়তে যাওয়ায় তার হাত ধরে ফেললাম। সে হাতটা আর ছাড়তেই দিলো না। যেন এমন সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল পাগলিটা। আমি তাকে দাঁড় করিয়ে তার পায়ে তার জন্য আনা একটা নুপুর পরিয়ে দিলাম। ‘অদিতি? আমার চাকুরীটা হয়ে গেছে। বেতন খুব অল্প। তবে চলে যাবে আমাদের দিন’।
সেদিনের সেই মুহূর্তটা আজও আমার চোখে ভাসে। সে কেমন করে খুশিটা প্রকাশ করবে সেটা নিয়ে তাকে প্রচন্ড দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে দেখছিলাম। সাময়িক এই দ্বন্দ্ব কাটিয়ে সে হুট করেই জড়িয়ে ধরেছিলো আমায়। তার চোখের কোণে জমা অশ্রুরা আমার শার্ট ভিজিয়ে দিয়েছিল। সময় পেরিয়ে যাচ্ছিলো, পাখিরা তাদের সারাদিনের ভীষণ ব্যস্ততাকে বিদায় জানিয়ে ফিরছিল গোধূলী আলোয় মেখে। সে তবু মুখ লুকিয়ে রেখেছিল এই বুকে। যেন নোনা জলে মাখা মুখটা দেখালেই মুহূর্তরাও ছুট দেবে পাখিদের সাথে। এমন মুগ্ধতা নিয়ে বাঁচার ভাগ্য কয়জনের হয়! এই মায়াবীমুখটাকে আগলে রাখতে হবে, এই সম্পর্কটাকে পবিত্রতার আলিঙ্গনে ঘিরে রাখতে হবে, সেই মুহূর্তে এই ভাবনাগুলো দায়িত্ববান হয়ে উঠতে চাইছিলো।
লেখাঃ তানভীর মাহতাব আবীর
Valobash thakok sober maja
hmm. thanks for your opinions