আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবির্ভাবের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তাযকিয়া ও পরিশুদ্ধি। আল্লাহর আদেশে তিনি মানবের কর্ম ও চরিত্রের পাশাপাশি তাঁর মন-মানস এবং বিশ্বাস ও চেতনাকে পরিশুদ্ধ, পরিচ্ছন্ন ও নির্মল করেছেন। এবং কিয়ামত পর্যন্ত বিশ্ব মানবতার জন্য ঐ দুই পরশপাথর রেখে গেছেন, যার স্পর্শে মানবের সকল ‘লোহা’ খাটি ‘সোনায়’ পরিণত হতে পারে। সেই দুই পরশপাথর হচ্ছে-আল কুরআন এবং আস-সুন্নাহ।
কুসংস্কার কাকে বলে? কুসংস্কার বলে নিছক ধারণা ও কল্পনা ভিত্তিক প্রমাণহীন বিশ্বাস এবং সেই বিশ্বাস-প্রসূত ভিত্তিহীন প্রথা ও কর্ম। যে হৃদয় ও মস্তিস্ক কুরআন-সুন্নাহর আলো থেকে বঞ্চিত তা-ই নানাবিধ বিভ্রান্তি ও কুসংস্কারের প্রজননক্ষেত্রে পরিণত হয়। একারণে দেখা যায়, পার্থিব শিক্ষা দীক্ষায় অগ্রসর হওয়ার পরও আজব আজব বিভ্রান্তি ও কুসংস্কারে মানুষ লিপ্ত থাকে। এমনকি ঐসবকেই গৌরবের বিষয় মনে করে।
আরব জাহেলিয়াতের মতো এখনও অনেক নারী-পুরুষ কুলক্ষণে বিশ্বাস করে। জপতপ, তন্ত্রমন্ত্রে আস্থা রাখে। জটাধারী ফকিরের পিছনে পিছনে ঘোরে। মূর্খ বে-শরা লোকদের অশ্লীল কথাবার্তাকে শিল্প-সংস্কৃতি গণ্য করে, এদের ‘জীবন’ ও ‘আদর্শ’ উদঘাটনের পিছনে জাতীয় অর্থ পানির মতো ব্যবহৃত হতে থাকে। সর্বোপরি জগতের সর্ব প্রাচীন ও সর্ব নিকৃষ্ট কুসংস্কার-পৌত্তলিকতা, ও মূর্তিপুজা তো এই বিজ্ঞানের যুগেও বিপুল সংখ্যক মানবের কাছে পরম গ্রহণীয়। ন্যাক্কারজনক বিষয় এই যে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশেও একশ্রেণীর ‘মুসলিম’ নামধারী ‘শিক্ষাবীদ’, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিক প্রতিমা পূজা এবং প্রতিমা কেন্দ্রিক সংস্কৃতিতেই শান্তি ও প্রশান্তি খুঁজে বেড়ায়। মুসলিম সমাজে পৌত্তলিকতাপ্রবণ চিন্তা ও মানসিকতা ছড়িয়ে দেওয়াকেই তারা অতি বড় মঙ্গলকার্য জ্ঞান করে।
এই সকল অনাচার ও কুসংস্কারের সুরক্ষায় তারা ব্যবহার করে উদারতা, আসাম্প্রদায়িকতা, পরমতসহিষ্ণুতার মতো শব্দাবলি। অথচ দেশে দেশে চরম সাম্প্রদায়িক পৌত্তলিক জনগোষ্ঠীর মুসলিম নিধনের সময় এই সকল শব্দ উচ্চারিত হয়।
মুসলিম কখনো আদর্শত্যাগী অর্থে ‘উদার’ হতে পারে না। ধর্মত্যাগী অর্থে ‘অসাম্প্রদায়িক’ হতে পারে না এবং ইসলাম, কুরআন, ইসলামের নবী এবং মুসলিম ভাইবোনের জান-মাল ইজ্জত-আব্রুর বিষয়ে নির্জীব ও নিস্পৃহ অর্থে ‘পরমতসহিষ্ণু’ হতে পারে না। মুসলিম যে উদারতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও পরমতসহিষ্ণুতায় বিশ্বাসী তা সত্যিকার অর্থেই উদারতা, অসাম্প্রদায়িকতা এবং পরমতসহিষ্ণুতা। এর নানান উজ্জ্বল দৃষ্টান্তে মুসলিম জাতির ইতিহাস-গগণ আলোকিত।
কুরআন-সুন্নাহর আলোক বঞ্চিত মানব-সমাজে আশ্লীলতা অভিহিত হয় ‘বিনোদন’ নামে। অনাচার অভিহিত হয় ‘তারুণ্যের ধর্ম’ নামে। আর নারীর রূপ-যৌবন বাজারজাত হয় ‘নারীমুক্তির’ নামে। সর্বোপরি চিন্তা-চেতনায় এই বিকৃতিকেই মনে করা হয় শিল্প ও প্রগতি। এই বিকৃতির পৃষ্ঠপোষকতার জন্য যে শ্রেণীটি আছে তারা ‘প্রগতিশীল’ নামে পরিচিত।
আলোকিত ধর্ম-ইসলামের প্রধান শিক্ষা ঈমান। ঈমানের বিপরীত হচ্ছে কুফর। ঈমান হচ্ছে আলো আর কুফর হচ্ছে অন্ধকার। সুতরাং কুফরের অন্ধকার থেকে মুক্তি পেতে হলে ঈমানের দিকে আসতে হবে।
ঈমানের অন্যতম প্রধান বিষয় ‘তাওহীদ’। তাওহীদের বিপরীত বিষয়টি শিরক। তাওহীদ হচ্ছে আলো আর শিরক হচ্ছে অন্ধকার। সুতরাং অন্ধকার থেকে মুক্তি পেতে হলে তাওহীদের আলোই গ্রহণ করতে হবে।
ইসলামের আরেক প্রধান শিক্ষা ‘সুন্নাহ’। সুন্নাহ হচ্ছে বিদআ’র বিপরীত। সুন্নাহ হচ্ছে আলো আর বিদআ হচ্ছে অন্ধকার। সুতরাং বিদআর অন্ধকার থেকে মুক্তি পেতে হলে সুন্নাহর দিকে আসতে হবে।
ইসলামের অন্যতম প্রধান শিক্ষা ‘আদাবে হাসান’ অর্থাৎ সুরুচি ও সুনীতি। এর বিপরীতে আছে ‘ফাওয়াহিশ’ অর্থাৎ অনাচার ও অশ্লীলতা। ‘আদাবে হাসান’ হচ্ছে আলো আর ‘ফাওয়াহিশ’ হচ্ছে অন্ধকার। সুতরাং ‘ফাওয়াহিশে’র অন্ধকার থেকে মুক্তি পেতে হলে ‘আদাবে হাসানে’র দিকেই আসতে হবে।
মানবজাতির সর্ববিধ অন্ধকার থেকে মুক্ত করার জন্যই কুরআনের আগমন। মহান আল্লাহ কত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন-(তরজমা) এটি সেই কিতাব যা আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি যেন তুমি মানুষকে বের করে আন অনেক অন্ধকার থেকে এক আলোর দিকে।-সূরা ইবরাহীম (১৪) : ০১
অনেকেই ইসলামকে শুধুমাত্র একটি ধর্ম হিসেবে দেখে থাকেন। এটা তাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ছাড়া কিছুই নয়। ইসলাম শুধুমাত্র একটি ধর্মের নাম নয় বরং সর্বকালের সর্বযুগের পরীক্ষিত সফল একটি অসাম্প্রদায়িক শাসনব্যবস্থা এবং বিশ্বমানবতার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা।
সাম্প্রদায়িকতা শব্দটির সঙ্গে আমরা কম-বেশি সবাই পরিচিত। পরিচিত এর ভয়াবহতা সম্পর্কেও। মূলত ধর্মীয়, জাতিগত বা আঞ্চলিক সংকীর্ণতাকেই বলে সাম্প্রদায়িকতা।
সাম্প্রদায়িকতার খারাপ বৈশিষ্ট্য হলো, অন্য ধর্ম, জাতি বা অঞ্চলের ব্যাপারে অসহিষ্ণু হওয়া। ইসলাম সাম্প্রদায়িকতাকে কোনো অবস্থাতেই সমর্থন করে না । মদিনার সনদ যার সুন্দরতম উদাহরণ। এই সনদের মাধ্যমে ইহুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক ও মুসলমানদের সমন্বয়ে একটি সাধারণ জাতি গঠিত হয়। যাতে সবার নাগরিক অধিকার ছিল সমান।
সনদে উল্লেখ ছিল, প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে, কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করবে না। কোনো সম্প্রদায় বাইরের শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে সবাই সম্মিলিতভাবে তা প্রতিহত করবে। এভাবে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মুসলিম-অমুসলিমদের সমন্বয়ে মদিনায় একটি স্থিতিশীল ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিপূর্ণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। একবার একজন সাহাবী রাসূলে কারীম (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন ‘আসাবিয়্যাত’ (সাম্প্রদায়িকতা) কী? জবাবে রাসূল (সা.) ইরশাদ করলেন, ‘অন্যায় কাজে স্বগোত্র-স্বজাতির পক্ষে দাঁড়ানো।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস: ৫০৭৮)
অর্থাৎ, অন্যায় ও জুলুমের কাজে কাউকে শুধু এ জন্য সমর্থন করা যে, সে তার নিজ দল, গোত্র, জাতি ও ধর্মের লোক-এটিই সাম্প্রদায়িকতা।
আবার, অসাম্প্রদায়িক মানে যা সাম্প্রদায়িক নয়। কোনো ধর্ম বা ব্যক্তিকে তখনই সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেওয়া হয় যখন সে এক বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্তির ভিত্তিতে অন্য এক ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং তার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধাচরণ এবং ক্ষতিসাধন করতে প্রস্তুত থাকে। অসাম্প্রদায়িক মানে, বিশেষ কোনো দল বা ধর্ম-সম্প্রদায় সম্পর্কে নিরপেক্ষ, সর্বজনীন; দলাদলি করার ভাব নাই এমন, উদার।
ইসলামের সংবিধিবদ্ধ নিয়মকানুন ও বিধিবিধান-সংবলিত নির্ভুল ঐশী কিতাব পবিত্র কোরআনুল কারীম ‘হুদাল্লিল আলামিন’ বা ‘হুদাল্লিন্নাস’, অর্থাৎ বিশ্ববাসীর জন্য পথনির্দেশক বা সমগ্র মানবজাতির জন্য হিদায়েতের গ্রন্থ হিসেবে আখ্যায়িত। তাই সার্বজনীন-বিশ্বজনীন এ মহাগ্রন্থ হতে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির প্রতি গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে এমন কিছু বাণীর উল্লেখ করছি :
মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআন মাজীদে বলেন যে, ‘তোমাদের ধর্ম তোমাদের কাছে আর আমার ধর্ম আমার কাছে।, (সূরা: কাফিরূন ১০৯, আয়াত: ৬)
এ সম্পর্কে অন্যত্র এসেছে যে, ‘আমাদের কর্ম আমাদের কাছে আর তোমাদের কর্ম তোমাদের কাছে। আমাদের ও তোমাদের মাঝে কোনো বিবাদ নেই। আল্লাহই আমাদের একত্র করবেন আর আমাদের সকলের প্রত্যাবর্তন তারই কাছে।’ (সূরা: শুরা ৪২, আয়াত:১৫)
আল কোরআনের বাকারাহ ও রুম সূরায় এসেছে যে, ‘তুমি একনিষ্ঠভাবে নিজেকে ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত করো।’ (সূরা: রুম ৩০,আয়াত ন: ৩০ )
‘ধর্মে কোনো জোরজবরদস্তি নেই্।’ (সূরা: বাকারাহ ২, আয়াত: ২৫৬)
‘তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে যারা আছে, তারা সকলেই ইমান আনয়ন করত। তবে কি তুমি বিশ্বাসী হওয়ার জন্য মানুষের ওপর জবরদস্তি করবে?’ (সূরা: ইউনূস ১০,আয়াত: ৯৯)
‘আর তারা আল্লাহকে ছেড়ে যাদের ডাকে, তাদের তোমরা গালি দেবে না। কেননা, তারাও তবে অজ্ঞানতাবশত আল্লাহকে গালি দেবে। এভাবে প্রত্যেক জাতির চোখে তাদের কার্যকলাপ শোভন করেছি। তারপর তাদের প্রতিপালকের কাছে তারা ফিরে যাবে। অতঃপর তিনি তাদের কৃতকার্য সম্বন্ধে তাদের জানিয়ে দেবেন।’ (সূরা: আন’আম ৬, আয়াত: ১০৮)
‘বলো, হে আহলে কিতাব! তোমরা তোমাদের ধর্ম সম্বন্ধে বাড়াবাড়ি করো না।’ (সূরা: মায়িদাহ ৫, আয়াত: ৭৭)
পবিত্র কোরআনে বিবৃত আল্লাহপাকের উল্লিখিত বাণীগুলোর ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন; বিভিন্ন ধর্ম ও ধর্মাবলম্বীদের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহনশীলতা, দায়িত্বশীলতা, সহিষ্ণুতা ও সম্প্রীতির বিষয়টিই এসব আয়াতে কারিমায় নির্দেশিত হয়েছে।
নবীজী ইসলামী রাষ্ট্র পূর্ববর্তী অন্যান্য ধর্ম ও আদর্শের অনুসারীদের তাদের নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার নিশ্চিত করে। এটা ধর্ম নিরপেক্ষতা বলা যেতে পারে কারণ সকল ধর্মের প্রতি কল্যান ও জোর জবরদস্তী ছাড়া ধর্ম পালন করা অসাম্প্রদায়িকতার মূল লক্ষ্য। অসাম্প্রদায়িকতার বানী হাদিস সমূহে যেভাবে এসেছে-
হজরত হুযাইফা (রা:) বর্ণনা করেন যে, রাসূলে কারীম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘সকল জাতি যেন তাদের বাপ-দাদা তথা বংশ নিয়ে গর্ববোধ থেকে ফিরে আসে অন্যথায় তারা আল্লাহর কাছে নাপাকির পোকামাকড় থেকেও নিকৃষ্ট গণ্য হবে।’ (মুসনাদে বাযযার, হাদীস: ২৯৩৮)
সুনানে আবু দাউদের অন্য বর্ণনায় আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষকে আসাবিয়্যাত (সাম্প্রদায়িকতা)-এর দিকে আহবান করবে (অর্থাৎ অন্যায় কাজে নিজ দল, গোত্র, জাতিকে সাহায্য করতে বলবে) সে আমাদের (মুসলমানদের) দলভুক্ত নয়। যে এমন সাম্প্রদায়িকতার কারণে মৃত্যুবরণ করবে সেও আমাদের দলভুক্ত নয়।” (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস: ৫০৮০)
মানবতার পরম সুহৃদ হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর উপস্থিতিতে একবার এক মসজিদের দরজায় এক অমুসলিম জনৈক ব্যক্তি প্রস্রাব করতে উদ্যত হলে সাহাবিরা যখন এর সমুচিত জবাব দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, দয়ার নবী (সা.) তখন সাহাবিদের থামিয়ে দিলেন। লোকটি কাজ সেরে যখন চলে যাচ্ছিল, তখন প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.) তাকে বুঝিয়ে বললেন- এটি আমাদের উপাসনার জায়গা, যা আমাদের কাছে খুবই পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র । এখানে ময়লা হলে আমাদের কষ্ট লাগে। ওই ব্যক্তি যা প্রমাণ করতে এসেছিল তা সে পেয়ে গেল। অর্থাৎ শেষ জমানার পয়গম্বর যিনি হবেন, তিনি চরম ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা বহন করবেন। আর সেটি প্রমাণের জন্যই তার অনাকাঙ্ক্ষিত কাজটি করা। প্রমাণ শেষে একত্ববাদের কালেমা পড়ে তিনি মহাসত্যে ইমান আনয়ন করলেন।
একজন অমুসলিম ব্যক্তির এরুপ অন্যায় কাজেও ঐ ব্যক্তির সঙ্গ নবীজী (সা.) সুন্দর সুশীল ব্যবহার ইসলামের অসাম্প্রদায়িকতার মূর্ত প্রতিক।
আর বিদায় হজের বিখ্যাত ভাষণের কথা তো সকলেরই জানা। যেখানে রাসূলুল্লাহ (সা.) দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন, ‘ভাষা, বর্ণ ও গোত্রের ভিত্তিতে কারো ওপর কারো প্রাধান্য নেই। তিনি বলেছেন, ‘কোনো আরব অনারবের ওপর (শুধু ভাষার কারণে) প্রাধান্য পাবে না। কোনো সাদা (তার বর্ণের কারণে) কালোর ওপর প্রাধান্য দাবি করতে পারবে না। প্রাধান্যের একমাত্র ভিত্তি হবে তাকওয়া।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদীস: ২৩৪৮৭)
উল্লেখ্য, মদিনা সনদে ‘বিসমিল্লাহ’ লেখা নেই বা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কথাও নেই। কারণ মদিনা সনদে স্বাক্ষরকারী সবাই মুসলমান ছিল না। হুদায়বিয়ার সন্ধিতে ‘বিসমিল্লাহ’ নেই এমন কি আমাদের প্রিয় নবী করীম (সা.) এর নাম সেখানে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ নয়, লেখা আছে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ কারণ এই চুক্তি ছিল মুসলিম এবং অমুসলিমদের মধ্যে। ঠিক একইভাবে, কোনো দেশের সংবিধান হলো মদিনা সনদের মত, ঐ রাষ্ট্রের সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে এক সঙ্গে বসবাস করার চুক্তি। ইচ্ছা করলেই সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ লেখা যায় না বা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করা যায় না, এটা ইসলাম সমর্থিত নয়। মদিনা সনদের শর্তসমূহগুলো নিচে তুলে ধরা হলো-
১. সনদপত্রে স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়সমূহ একটি সাধারণ জাতি গঠন করবে,
২. কোনো সম্প্রদায় গোপনে কুরাইশদের সঙ্গে কোনো প্রকার সন্ধি করতে পারবে না কিংবা মদীনা বা মদীনাবাসীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে কুরাইশদের কোনোরুপ সাহায্য-সহযোগীতা করতে পারবে না,
৩. মুসলিম, খ্রীস্টান, ইহুদী, পৌত্তলিক ও অন্যান্য সম্প্রদায় ধর্মীয় ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে। কেউ কারো ধর্মীয় কাজে কোনো রকম হস্তক্ষেপ করতে পারবে না,
৪. মদিনার ওপর যে কোনো বহিরাক্রমণকে রাষ্ট্রের জন্য বিপদ বলে গণ্য করতে হবে। এবং সেই আক্রমণকে প্রতিরোধ করার জন্য সকল সম্প্রদায়কে এক জোট হয়ে অগ্রসর হতে হবে,
৫. রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের অধিকার ও নিরাপত্তা রক্ষার ব্যবস্থা থাকবে,
৬. অসহায় ও দূর্বলকে সর্বাবস্থায় সাহায্য ও রক্ষা করতে হবে,
৭. সকল প্রকার রক্তক্ষয়, হত্যা ও বলাৎকার নিষিদ্ধ করতে হবে এবং মদীনাকে পবিত্র নগরী বলে ঘোষণা করা হবে,
৮. কোনো লোক ব্যক্তিগত অপরাধ করলে তা ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবেই বিচার করা হবে। তজ্জন্য অপরাধীর সম্প্রদায়কে দায়ী করা যাবে না,
৯. মুসলমান, ইহুদী ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরা পরষ্পর বন্ধুসুলভ আচরণ করবে,
১০. রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিরোধ নিষ্পত্তির অধিকার থাকবে রাষ্ট্র প্রধানের এবং তিনি হবেন সর্বোচ্চ বিচারালয়ের সর্বোচ্চ বিচারক,
১১. মুহাম্মাদ (সা.) এর অনুমতি ব্যতীত মদীনাবাসীগণ কারও বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে না,
১২. মুসলমানদের কেউ যদি ঘোর অন্যায় কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে সবাই মিলে তার বিরুদ্ধে যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। নিজ সন্তান বা আত্নীয় হলেও এ ব্যাপারে তাকে ক্ষমা করা যাবে না,
১৩. ইহুদিদের মিত্ররাও সমান নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা ভোগ করবে।
উপরোক্ত শর্তসমূহের আলোকে এটাই সুস্পষ্টভাবে প্রমানিত হয় যে, অসাম্প্রদায়িক সমাজ ব্যবস্থাকে ইসলাম সমর্থন করে। মদিনা সনদ ধর্মভিত্তিক কোনো রাজনীতিকে সমর্থন করে না। শুধু তাই নয়, ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা মদিনা সনদে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে।
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বের সকল দেশের মানুষের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনেতিক মুক্তির জন্য ইসলামই একমাত্র পরীক্ষিত শাসন ব্যবস্থা। রাসূল (সা.) ও সাহাবিদের শাসনামল যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যেখানে রাস্তার একটা কুকুরের খাদ্য নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব হয়েছে; যেখানে রাতের আঁধারে নারী একাকি পথ চলতে পেরেছে নিশ্চিন্তে। সকল ধর্মের মানুষ পেয়েছে ন্যায়বিচার, পেয়েছে স্বাধীনভাবে স্বীয় ধর্ম পালন ও বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা।
বর্তমানে সারা বিশ্বে কোনো পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্র নেই। আর তাই আমরা ইসলামী রাষ্ট্রের উদাহরণ টানতে পারি না। উদাহরণ দিতে হলে ফিরে যেতে হয় অনেক পিছনে। সবশেষে আবার এ কথাটিই দাবি করছি- বর্তমান বিশ্বমানবতার মুক্তির জন্য, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামই উপযুক্ত এবং একমাত্র অসাম্প্রদায়িক শাসনব্যবস্থা।
সবশেষে বলা যায় যে, ইসলাম ধর্ম একমাত্র ধর্ম যে ধর্মকে কোরআন শরীফ স্বীকৃতি দিচ্ছে আর অন্য কোন ধর্মকে কোরআন স্বীকৃতি দিচ্ছে না যেহেতু কোরআন আসমানী গ্রন্থ এবং সর্বশেষ গ্রন্থ তাই নির্ধিদায় বলতে হয় যে ইসলাম ধর্ম হচ্ছে একমাত্র ধর্ম যা সৃষ্টিকর্তার ।কোরআন শরীফ এমন একটি গ্রন্থ যেটিকে সৃষ্টিকর্তা স্বীকৃতি দিচ্ছে। শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য নয় কোরআন শরীফে ,কোরআন শরীফ সারা পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য এসেছে।পৃথিবীর আদি লগ্ন থেকে শুরু করে এবং পৃথিবীর শেষ অবধি পর্যন্ত সকল কিছু লিপিবদ্ধ আছে এবং ভবিষ্যতে কি হবে এবং এই পৃথিবীর সৃষ্টি রহস্য সকল কিছু লিপিবদ্ধ আছে আপনি আর অন্য কোন গ্রন্থে এত কিছু পাবেন না আপনি কোরআন কে নিয়ে যখন গবেষণা করবেন তখন আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন। আসলে কোরআন একটি সৃষ্টিকর্তার মনোনীত ধর্ম।তাই বলতে হয় ইসলাম ধর্মই হচ্ছে একমাত্র সত্য ধর্ম।
তথ্য সূত্র:
কুসংস্কারের উপশম কুরআন-সুন্নায় – মাসিক আলকাউসার
ইসলাম ধর্ম: অসাম্প্রদায়িক চেতনার অন্যতম উদাহরণ